ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন প্রাইম ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ অফিসার ও দৈনিক সমকালের যুগ্ম বার্তা সম্পাদক জাহেদুল আলম রুবেলের সহধর্মিণী ফারজানা শারমিন। গতকাল শুক্রবার ভোরে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে মারা যান তিনি (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)।
ফারজানা শারমিনের দুই সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে ফাতিহা রিদ্বীনের বয়স ১১ বছর। সে বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। ছোট ছেলে আইয়ান তিহানের বয়স চার। সেও একই স্কুলে প্লে গ্রুপে অধ্যয়নরত। গত তিন দিন মাকে দেখতে না পেয়ে সে মাঝেমধ্যেই জানতে চাচ্ছে– মা কোথায়? ছোট্ট এই শিশু দুটি জানেই না, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে তাদের মা চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর পর তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর কাঁঠালবাগান এলাকার বাসভবনে। দুই সন্তানকে তখনও জানানো হয়নি মায়ের মৃত্যুর সংবাদ। মায়ের নিথর দেহ দেখে তাদের সামলানো কঠিন হবে ভেবে আগেই লাশবাহী গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয় নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার জারিয়ার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে। গ্রামের যাওয়ার পর মেয়ে বুঝতে পারে তার মমতাময়ী মা আর নেই। তবে তিহান তখনও কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। কিছুক্ষণ পরপর মাকে খুঁজে ফেরে সে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার সময় রুবেল-শারমিনের পরিচয়। সেই থেকে দু’জনের একসঙ্গে পথচলা। শারমিনের চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ১২ বছর ধরে তিলে তিলে সাজানো সংসার হঠাৎ এক ঝড়ে এলোমেলো হয়ে গেল। স্ত্রীকে হারিয়ে যেন কষ্টের অথই সাগরে পড়েছেন রুবেল। স্ত্রীকে নিয়ে বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে ছিল ছোট্ট সুখের ঘর। বিন্দু বিন্দু ঘামে ও পরিশ্রমে কেবল স্বপ্নের কুঁড়ি ফুটতে শুরু করেছে। কিন্তু হঠাৎ আঁধার নেমে এলো, যা তিন দিন আগে দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেননি তিনি। একটি মশা তাঁর জীবনকে ওলটপালট করে দিল।
তিনি আরও বলেন, আর্থ্রাইটিসের সমস্যা থাকায় ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার আগে শরীর ব্যথার কারণে তিন দিন ঘুমাতে পারেনি শারমিন। এমন অবস্থায় গত সোমবার হালকা জ্বর দেখা দেয়। জ্বর নিয়ে অফিসও করে। মঙ্গলবার সকালে রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। তবে অন্যান্য জটিলতা না থাকায় বাসাতেই ছিল। সন্ধ্যায় হঠাৎ শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতাল ভর্তি করা হয়। জটিলতা বাড়ায় সঙ্গে সঙ্গে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র-আইসিইউতে নেওয়া হয়। তাঁর প্লাটিলেট নেমে যায় ১০ হাজারে। চিকিৎসক চার ব্যাগ প্লাজমা দেওয়ার পরামর্শ দেন। তবে বিভিন্ন সমস্যা থাকায় চারজনের প্লাজমা নেওয়া যাবে না বলে জানিয়ে দেন তারা। পরে একজনের প্লাজমা নেওয়া হয়। তবে প্লাজমা দিলেও তাঁর শরীরে প্লাটিলেট বাড়াতে পারেনি। বুধবার দুপুরে ফারজানাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়।
চিকিৎসকরা জানান, উপসর্গ ছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন শারমিন। জ্বর চলে যাওয়ার পর ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। তাই রক্তচাপ ও রক্তে অণুচক্রিকার পরিমাণ অতি দ্রুত কমে যায়। পরিস্থিতি দ্রুত খারাপ হয়ে পড়ে, রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়। অন্য অঙ্গগুলো আস্তে আস্তে নিষ্ক্রিয় হতে থাকে। পেট ফুলে যায়। ফুসফুসে পানি ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে লিভার ও কিডনির কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। তারা এটিকে ডেঙ্গুর শক সিনড্রোম বলে জানান।
রুবেল আহাজারি করতে করতে বলেন, ছোট এক মশা আমার দুই সন্তানকে এতিম করে দিল। অনেক কষ্ট করে সংসারটা গুছিয়ে এনেছিলাম। ছোট্ট দুই সন্তানকে নিয়ে আমি কীভাবে থাকব? আমার সব শেষ হয়ে গেল। সন্তানদের আমি কী সান্ত্বনা দেব?
ফারজানা শারমিন তপি প্রাইম ব্যাংকের এলিফ্যান্ট রোড শাখায় কর্মরত ছিলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৪৩ বছর। চার বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। গতকাল বাদ আসর জানাজা শেষে তাঁর লাশ নিজ এলাকা নেত্রকোনার জারিয়া গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে মায়ের পাশে দাফন করা হয়। এ সময় কংশ নদের পাড়ের এ গ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে। দাফনের পরই অঝোর ধারায় নামে বৃষ্টি, যেন শারমিনের শোকে কাঁদছে প্রকৃতিও। দুই সন্তান ও তাঁর স্বামীকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন সবাই।
তাঁর সহকর্মীরা বলেন, খুবই প্রাণচঞ্চল ছিলেন শারমিন। তিনি ছিলেন প্রাইম ব্যাংকের রত্ন। খুবই কম সময়ের মধ্যে সবার প্রিয় মুখ হয়ে উঠেছিলেন। শেষ অফিসের দিন শারীরিক অসুস্থতার কারণে একটু আগে অফিস থেকে বের হন। তাঁর সঙ্গে আর দেখা হবে না ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে।
তাঁর অকাল মৃত্যুতে শোকাহত সমকাল, প্রাইম ব্যাংকের সহকর্মী এবং তাঁর স্বজনরা। এর আগে খবর পেয়ে শুক্রবার ভোরে স্বজন, সহকর্মী ও সমকালের সাংবাদিকরা ছুটে যান স্কয়ার হাসপাতালে। এ সময় সেখানে স্বজনের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। জাহেদুল আলম রুবেলের স্ত্রীর মৃত্যুতে সমকাল পরিবারের পক্ষে গভীর শোক জানিয়েছেন সম্পাদক আলমগীর হোসেন। তিনি প্রয়াতের রুহের মাগফেরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।