উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর বিচ্ছিন্ন উপজেলা রাঙ্গাবালী। তেঁতুলিয়া নদীর মোহনায় অবস্থিত এই দ্বীপ একসময় ছিল অন্ধকারে। ভরসা শুধু সৌরবিদ্যুৎ, মোমবাতি কিংবা হারিকেনের আলো। জেলা সদর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরের এই জনপদে নদীর তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে সরকার। আর এতে পাল্টে গেছে রাঙ্গাবালীর অর্থনীতি। কলকারখানা স্থাপনের পাশাপাশি নতুন বিভিন্ন ব্যবসার দ্বার খুলেছে সেখানে। এ রকম অমিত সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে উপকূলীয় দ্বীপ হাতিয়া, নিঝুমদ্বীপ এবং কুতুবদিয়ায়।
বিচ্ছিন্ন এই তিন জনপদে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে নাগরিক সেবার মান এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা সম্ভব হবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিদ্যুৎ বিভাগের উদ্যোগে এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প গত ১২ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি-একনেকে অনুমোদন হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন– ‘কেউ অন্ধকারে থাকবে না, সবার ঘরে আলো জ্বলবে’। তারই প্রতিফলন দুর্গম এলাকায় শতভাগ বিদ্যুতায়নের উদ্যোগ।
সূর্য ডোবার পর রাঙ্গাবালীর বেশির ভাগ মানুষের ভরসা ছিল কুপি কিংবা হারিকেন। রাতের অন্ধকারে এই জনপদের মানুষ ঘর থেকে খুব একটা বের হতেন না। সৌরবিদ্যুতের দেখা মিলতো মধ্যম আয়ের মানুষের ঘরে, তা-ও সবার ঘরে না। গরমে বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহার করার উপায় ছিল না, হাতপাখাই ছিল ভরসা। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ছিল রাঙ্গাবালীর মানুষের কাছে স্বপ্নের মতো। কলকারখানা না থাকায় জীবিকার সন্ধানে তারা ছুটতেন শহরের দিকে। তবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে সেখানে পৌঁছে গেছে স্বপ্নের বিদ্যুৎ; ঘরে ঘরে জ্বলছে বাতি, ঘুরছে বৈদ্যুতিক পাখা।
নিঝুমদ্বীপ। বঙ্গোপসাগরের ছোট্ট একটি দ্বীপ। প্রায় ১৪ হাজার ৫০ একর আয়তনের এই দ্বীপটি শীতকালে পর্যটকদের জন্য অন্যতম গন্তব্য। পরিযায়ী পাখির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা দ্বীপ। হরিণ দেখার জন্যও সারাবছর পর্যটকের আনাগোনা থাকে এই দ্বীপে। অসংখ্য পর্যটক করেন রাত্রিযাপন। বিদ্যুৎ না থাকায় এতদিন তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা পায়নি সেখানে যাওয়া পর্যটকরা। সন্ধ্যায় বাজারে সৌরবিদ্যুতের আলোতে মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন মোবাইলে চার্জ করার জন্য। এই দ্বীপের বাসিন্দাদের জীবনমানের পরিবর্তন কিংবা বিদ্যুতের সুবিধা ভোগ করার কথা কেউ কল্পনাও করেনি। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হলে পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়বে, যা এখন খুবই সামান্য। আর পর্যটকের আনাগোনা বাড়লে দ্বীপবাসীর অর্থনৈতিক ভাগ্য ঘুরে দাঁড়াবে।
নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার আয়তন ২১০০ বর্গকিলোমিটার। সাড়ে চার লাখের বেশি মানুষের বসবাস এই দ্বীপে। সেখানে যেতে হলে পাড়ি দিতে হয় বিশাল জলরাশি। হাতিয়ার একটি বড় অংশে বিদ্যুৎ না থাকায় বিশেষ কোনো সুবিধা পায়নি পর্যটকরা। ছিল না রাত্রিযাপনেরও তেমন কোনো ব্যবস্থা। দুর্গম সেসব এলাকায়ও বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
এতো গেল মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মোহনার র্দুগম নিঝুমদ্বীপ, হাতিয়া এবং রাঙ্গাবালীর গল্প। এবার বলব বঙ্গোপসাগরের আরেক দ্বীপ কুতুবদিয়ার কথা। ২১৬ বর্গকিলোমিটার এই দ্বীপে রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র, সমুদ্র সৈকত, লবণ চাষ, বাতিঘর এবং কুতুব আউলিয়ার মাজার। এখানেও বিভিন্ন সময়ে পর্যটকরা যাতায়াত করেন। তবে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা এবং সুযোগ-সুবিধা কম থাকায় সেখানে দিনে গিয়ে দিনেই চলে আসেন বেশির ভাগ পর্যটক।
‘হাতিয়া দ্বীপ, নিঝুমদ্বীপ ও কুতুবদিয়া দ্বীপ শতভাগ বিদ্যুতায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। প্রকল্পটি গত জুনে শতভাগ বাস্তবায়নের কথা থাকলেও সম্ভব হয়নি। ২০২৫ সালের জুলাইয়ে শতভাগ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। হাতিয়া দ্বীপ শতভাগ বিদ্যুতায়ন করা, সাবমেরিন ক্যাবল দিয়ে কুতুবদিয়া দ্বীপ শতভাগ বিদ্যুতায়ন করা এবং হাতিয়া দ্বীপ, নিঝুম দ্বীপ ও কুতুবদিয়া দ্বীপের শতভাগ গ্রাহককে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনতেই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে এই প্রকল্প।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানিয়েছে, এই প্রকল্পের আওতায় নতুন চারটি ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্র নির্মাণ (হাতিয়ায় তিনটি ও কুতুবদিয়ায় একটি), মুকতারিয়া-নিঝুমদ্বীপ খালে দেড় কিলোমিটার ১১ কেভি সাবমেরিন ক্যাবল বসানো হবে। কুতুবদিয়া চ্যানেলে ৫ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট ৩৩ কেভি সাবমেরিন ক্যাবল দিয়ে নতুন করে ১ হাজার ৪৮৬ কিলোমিটার বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হবে। বিদ্যমান ৩৫ কিলোমিটার বিতরণ লাইনও সংস্কার করা হবে। মোট ৩ হাজার ২৫০টি পোল মাউন্টেড বিতরণ ট্রান্সফরমার বসানো এবং অফিস ভবন কাম রেস্ট হাউজ, ডরমিটরি, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হবে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে উপকূলীয় এলাকার হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ ও কুতুবদিয়ায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে নাগরিক সেবার গুণগত মান উন্নয়ন করা সম্ভব হবে।