নব্বই দশকে নিজের মতামত প্রকাশ করাটা আজকের মতো সহজ ছিল না। মন চাইলেই ফেসবুকে দু’চার লাইন লিখে পাঁচ-ছয় ঘন্টার মধ্যে ভাইরাল হওয়া যেত না। মতামত প্রকাশ করার ইচ্ছে হলে পত্রিকায় চিঠি লিখতে হত।
জনতার ওই একটাই ছিল প্ল্যাটফর্ম। সেখানেও সম্পাদক মহাশয় ছিলেন। পাঠকের চিঠি সম্পাদনা করতেন তিনি। পাঠক মনের মাধুরী মিশিয়ে যা-ই লিখবেন, তাই হুবহু ছাপার সুযোগ ছিল না। অবশ্য সম্পাদকের কাঁচির কারণে অনেক অখাদ্য লেখাও অনেক সময় সুখপাঠ্য হয়ে যেত। আবার অনেক সময় নিজের স্বাধীন মতামতের ওপর সম্পাদকের অযাচিত হস্তক্ষেপে দু:খ পেতেন পাঠক। তবে এই প্রক্রিয়ায় একটা জিনিস নিশ্চিত করা হতো, তা হচ্ছে: লেখার মান। পাঠকের লেখার ভাষাগত ত্রুটি শুদ্ধ করে তবেই সম্পাদক লেখা প্রেসে দিতেন। পাঠকের জন্য চিঠিপত্র কলাম এজন্য ছিল লেখালেখি শেখারও জায়গা।
এখন ফেসবুকে যে লক্ষ-লক্ষ মতামত প্রকাশ হতে দেখি, তার সব তো লেখা নয়, অধিকাংশই ব্যক্তিগত ডায়েরি থেকে তুলে দেয়া নির্দিষ্ট তারিখের ভাবনা। কিন্তু বিচ্ছিন্ন রাগ, ক্ষোভ, অভিমান ছাড়াও বহু মানুষ ফেসবুকে নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয়ে লেখালেখি করেন। সেই লেখাগুলো পত্রিকায় পাঠকদের পাতায় ছাপা লেখাগুলোর সমতুল্য।
তফাৎ হচ্ছে, ফেসবুকে কোনো সম্পাদক নেই। সবার সব লেখাই প্রকাশ হচ্ছে, কারণ, প্রকাশের ক্ষমতা লেখকের নিজের হাতেই। ফলে অধিকাংশ লেখায় ভাষার শুদ্ধতা নেই। লেখাগুলো শুধু মতামত হয়েই থেকে যাচ্ছে, ‘লেখা’ হয়ে উঠছে না। সেই সময়ও পত্রিকায় প্রচুর লেখা জমা হতো। সব লেখা ছাপা হতো না মানের অভাবে। পত্রিকার বাতিল বাক্সে ঠাই হত এসব লেখা। অচল বাতিল বাক্সে যাওয়ার উপযোগী লেখা দিব্যি ফেসবুক গ্রুপগুলোতে প্রকাশ পাচ্ছে।
লেখকের নিজের ওয়াল ছাড়াও লেখালেখির কিছু প্ল্যাটফর্ম হয়েছে ফেসবুকে। বিভিন্ন বিষযভিত্তিক গ্রুপ আছে, যেখানে লেখা জমা দেয়া যায়, ওই গ্রুপগুলোর এডমিনরা চাইলে সেসব লেখা প্রকাশ পায়।
এডমিনরা হচ্ছেন একালের সম্পাদকের ভূমিকায়। সরকার পত্রিকার লাইসেন্স দেয় মালিককে, মালিক নিয়োগ দেন সম্পাদককে, সম্পাদক আবার বিভিন্ন বিভাগীয় সম্পাদকদেরকে, তাদের মধ্যেই একজন পাঠকের লেখা বাছাই করেন। কিন্তু ফেসবুক গ্রুপে কোনো বিভাগীয় সম্পাদক নাই। গ্রুপ এডমিন নিজেই পেজ খোলেন, নিজেই এডমিন পছন্দ করেন, তারপর এডমিনরা সকলে মিলে কোনো লোকের পাঠানো লেখা প্রকাশ করেন কিংবা বাতিল করেন। শুধু সম্পাদক নেই বলেই এখান থেকে লেখক তৈরি হওয়ার সুযোগ নেই।
হ্যাঁ, সেখানেও দু’চারজন ভালো লেখেন। ওটা গ্রুপগুলোর কৃতিত্ব নয় কোনোমতেই। ওই লেখকরা নিজ যোগ্যতায়, পরিশ্রমে, সাধনায় ভালো করে থাকেন।
বর্তমানে ফেসবুক গ্রুপগুলোর মধ্যে অন্যতম বিভিন্ন সিনেমার গ্রুপ। গ্রুপগুলোর মধ্যেই লেখালেখি সীমাবদ্ধ থাকলে আজকের এই আলোচনার প্রয়োজন পড়ত না। বিভিন্ন নায়ক-নায়িকার ভক্তরা ফেসবুকে গ্রুপে তর্ক-বিতর্ক করলেও তা সমস্যা ছিল না।
সমস্যা হচ্ছে, এই ফেসবুক গ্রুপগুলোকে মাথায় তুলে ফেলেছেন নির্মাতা ও শিল্পীরা। কোনো কোনো নির্মাতা কিংবা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কোনো গ্রুপকে কিংবা গ্রুপের দু’চারজন লেখককে দায়িত্ব দিচ্ছেন নিজেদের কন্টেন্ট প্রমোশনের। গ্রুপগুলোতে নির্দিষ্ট লেখকরা রিভিউ লিখছেন, সেসব রিভিউ ফেসবুকে শেয়ার দিয়ে কন্টেন্টের জনপ্রিয়তা প্রমাণের চেষ্টা করছেন সংশ্লিষ্টরা, নিজেদের কন্টেটকে আলোচনায় আনার চেষ্টা করছেন। এজন্য চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখালেখির গ্রুপ পরিণত হয়েছে প্রযোজকদের পাবিলিসিটি টুলে।
আমরা নব্বই দশকে পত্রিকার চিঠিপত্র কলামে সিনেমার নানা দিক নিয়ে লিখতাম, প্রিয় তারকাকে নিয়ে লিখতাম। তর্ক করতাম, বিতর্ক করতাম। কিন্তু কখনো বিক্রি হয়ে যাইনি, কারও বিক্রি হওয়ার কথা শুনিওনি।
ইদানিং কোনো সিনেমা বা ওয়েব ফিল্ম রিলিজ হলেই দেখা যায়, একদল সিনেমাবিষয়ক ফেসবুক লেখক প্রশংসার তুবড়ি ছুটিয়ে রিভিউ লিখছেন। রিভিউগুলো নির্দোষ হলে কোনো কথা ছিল না। কিন্তু এগুলো রিভিউ নয়, এককতরফা প্রশংসাপত্র- প্রযোজকের সঙ্গে চুক্তি করে লেখা রিভিউ। যদিও এই লেখকদের রিভিউ লেখার যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে; সে প্রশ্ন ওঠে না, কারণ, সেগুলো প্রচলিত অর্থে রিভিউ নয়- দর্শকের মতামত বলা যেতে পারে।
প্রযোজনা সংস্থাগুলো প্রচলিত মিডিয়াতে বিজ্ঞাপন না দিয়ে পয়সা খরচ করছেন গ্রুপগুলোতে; কারণ, এই গ্রুপগুলোর সদস্য সাধারণ ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। প্রযোজকরা যেখানে নিজেদের কন্টেন্টের প্রচার করতে পারবেন, সেখানেই পয়সা খরচ করবেন। আফসোসের জায়গা হচ্ছে, ভালো লেখক তৈরি হওয়ার প্ল্যাটফর্ম হতে পারল না গ্রুপগুলো, উল্টো হয়ে উঠলো লেখালেখির দোকান- যেখানে লেখক তৈরি হচ্ছে না, তৈরি হচ্ছে পিআর লেখক!