গত ৩ আগস্ট প্রকাশিত হয়েছে ৪১তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল। এতে বিভিন্ন ক্যাডারে দুই হাজার ৫২০ জন প্রার্থীকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। ৪১তম বিসিএসে কৃষি ক্যাডারে প্রথম হয়েছেন রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) ৭৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. জাহিদুর রহমান। সম্প্রতি জাহিদুর রহমান বিসিএস পরীক্ষায় কৃষি ক্যাডারে প্রথম হওয়া, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জাগো নিউজ প্রতিনিধি তাসনিম আহমেদ তানিম।
জাগো নিউজ: আপনার শৈশবের গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই
জাহিদুর রহমান: আমার জন্ম সাতক্ষীরার তালা থানার খেশরা ইউনিয়নের নিরিবিলি গ্রাম শাহপুরে। গ্রামে থাকার কারণে শৈশবটা দুরন্তপনার মধ্যেই কেটেছে। কৃষি ও কৃষক সমাজের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে আমার বেড়ে ওঠা। গ্রামের প্রাকৃতিক ও মানবিক প্রাচুর্যে আমার ছেলেবেলা সমৃদ্ধ হয়েছে নানা স্মৃতিতে।
জাগো নিউজ: স্কুল-কলেজে সফলতার হাতছানি কেমন ছিল?
জাহিদুর রহমান: ৪৯ নং শাহপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু করেছিলাম। এরপর এইচ. এম. এস. মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মাধ্যমিক শিক্ষাজীবন পার করেছি। আমাদের সময়ে স্কুলটির জরাজীর্ণ অবস্থা ছিল। ভাঙাচোরা ইটের কাঠামোর উপরে টিনের চালা আর দরজা জানালাহীন এক অদ্ভুত দর্শন প্রতিষ্ঠান ছিল সেটি। স্কুল পেরিয়ে ভর্তি হই প্রায় ১৩-১৪ কিলোমিটার দূরের আর. কে. বি. কে হরিশ্চন্দ্র কলেজিয়েট ইনস্টিটিউটে। গ্রামের কাঁচা রাস্তা ভেঙে সব ঋতুতেই কলেজে যাতায়াত ছিল কষ্টকর। তবে স্কুল-কলেজের এসব প্রতিবন্ধকতাকে আমি বা আমার কোনো বন্ধুই বাধা হিসেবে নিইনি। সব কষ্ট একপাশে রেখে আমরা সত্যিই উপভোগ করেছি সময়গুলো।
জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?
জাহিদুর রহমান: দেখুন, আমি এমন একটা জায়গায় বেড়ে উঠেছি যেখানে প্রায়ই আমার ঘুম ভাঙতো মানুষের ঝগড়ার শব্দ শুনে। এমন জায়গায় জীবনের হিসাব ঠিক সরলপথে চলে না। গ্রামের অন্যান্য ছেলেমেয়ের মতো পড়াশোনায় প্রতিবন্ধকতা আমারও ছিল। সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক সব ধরনের চাপই ছিল। তবে আমি এগুলো খারাপভাবে নিইনি কখনো। কারণ, এসব প্রতিবন্ধকতাই আপনাকে শক্তিশালী করবে। বড় হওয়ার পরে যে ঝড়ই এসেছে তা মোকাবিলা করতে পেরেছি ছোটবেলার শক্তি থেকেই। অবশ্য ছোটবেলা আমার সামনে যত বাধা-বিপত্তি এসেছিল তার অধিকাংশ আঘাত আমার মা নিজে সয়ে আমাকে আগলে রেখেছিলেন সবসময়।
জাগো নিউজ: বিসিএসের ঝোঁক তৈরি হলো কীভাবে?
জাহিদুর রহমান: পড়াশোনা শেষে সবাই সবচেয়ে ভালো ক্যারিয়ারটা গড়তে চায়। আমার ক্ষেত্রেও ভিন্নতা নেই। সবসময় বিজ্ঞানের প্রতি অনুরক্ত আমার গবেষণায় আগ্রহ ছিল বরাবরই। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পরে সেই আগ্রহের পালে হাওয়া লাগে আরও জোরেশোরে। স্নাতক শেষে আমার সিজিপিএ দাঁড়ায় ৩.৯০। পরে বর্তমান চাকরির বাজারের বাস্তবতার সঙ্গে তাল মেলাতে গবেষক হওয়ার চেষ্টার পাশাপাশি বিসিএসের পড়াশোনা শুরু করি।
জাগো নিউজ: এটাই কি প্রথম চাকরি?
জাহিদুর রহমান: ৪১তম বিসিএস আমার প্রথম বিসিএস ছিল। বিসিএসসহ এখন পর্যন্ত চাকরি পেয়েছি পাঁচটি। বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার আগে সিএজি’ অডিটর, সিভিল এভিয়েশন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রভাষক (কৃষি), বিএআরআই’তে সাইন্টিফিক অফিসার, বাংলাদেশ ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডে এইও পদে চাকরি পাই। এখনো ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডেই আছি।
জাগো নিউজ: সফলতার পেছনে কার অনুপ্রেরণা ছিল?
মো. জাহিদুর রহমান: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা অনেকাংশেই একটি ভীতিমূলক। সফল হওয়ার প্রচণ্ড চাপে এখানে একা চলার মানসিক শক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। পরিবারের সবার অবদানের মধ্যে আমার মূল অনুপ্রেরণা আমার মায়ের পরিশ্রম। হাজারো নেতিবাচকতার স্রোত ঠেলে নিজের সততা আর নিষ্ঠার আলোয় পথ চলার যে অপরিমেয় শক্তি তিনি দেখিয়েছেন, তার সন্তান হিসেবে আমি কখনো হতাশার আড়ালে বসে থাকতে পারিনি। তার শিক্ষাই আমার দৃঢ়তার ভিত্তি।
জাগো নিউজ: নতুনরা বিসিএসের প্রস্তুতি কীভাবে শুরু করবেন, তাদের জন্য বিশেষ কোনো উপদেশ আছে?
জাহিদুর রহমান: বিসিএস প্রস্তুতির মূল ভিত্তিই হলো ধৈর্য। তিন ধাপের পরীক্ষাটির প্রতি ধাপে আলাদা আলাদা প্রস্তুতি আর প্রতিবারে ফলাফলের জন্য অপেক্ষা; সবমিলিয়ে পরীক্ষাটি শারীরিক ও মানসিক চাপের সমার্থক শব্দ যেন। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (বিপিএসসি) প্রণীত নির্দিষ্ট সিলেবাস অনুযায়ী পরীক্ষা হয়। তবে শুধু সিলেবাসের মধ্যে থেকে পড়াশোনা করে বিসিএসে বিশেষ ভালো করা সম্ভব নয়। নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে নানাভাবে, সাজাতে হবে আধুনিক সব অস্ত্রে, যাতে কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দিশেহারা হতে না হয়। বিসিএসের বই পড়ার পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়ে নিজের বুদ্ধিবৃত্তিকে শাণিত করুন। নিজের জ্ঞানকে কীভাবে বিসিএসে কাজে লাগানো যায় সে বিষয়ে সচেতন সিদ্ধান্ত নিন। প্রস্তুতির শুরুর দিকে নিজেকে সব বিষয়ে বিস্তারিত জানার প্রতি আগ্রহী করে তুলুন। বিষয়ভিত্তিক প্রস্তুতির এখন হাজারো গাইডলাইন আছে। সেগুলো অনুসরণ করুন, তবে অনুকরণ না করে নিজের জন্যে সুবিধাজনক পদ্ধতি তৈরি করে নিতে পারেন। মনে রাখবেন, বিসিএস দৌড়ে যোগ দেওয়ার মানে হলো নিজেকে হাজারো অনিশ্চয়তায় যুক্ত করা। এখানে সাফল্য ও ব্যর্থতার দেখা পাবেন পদে পদে। হতাশ না হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যান। সফলতার দেখা কম পেলে নিজের চেষ্টা ঠিক পথে হচ্ছে কি না সে বিষয়ে যথার্থ কারও পরামর্শ নিন।
জাগো নিউজ: অন্যান্য টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় যেমন বাকৃবির তুলনায় শিক্ষার্থী অনুপাতে শেকৃবিতে ক্যাডার সংখ্যা কম। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
জাহিদুর রহমান: অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙেবগ তুলনায় যেতে চাই না। তবে আমার দেখামতে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব রয়েছে। বিসিএস প্রিলিমিনারি থেকে ভাইভা পর্যন্ত প্রস্তুতি কীভাবে নিলে সেটা বেশি কার্যকর হতে পারে সে বিষয়ে অধিকাংশেরই ধারণা অনেক কম। কোন বই ভালো হবে, কোন কোচিং ভালো হবে- এসব প্রশ্ন বেশি না করে নিজের পড়ার টেবিলে কী কী হচ্ছে, তা কতটা কার্যকর- সেসব বিষয়ে বেশি মনোযোগী হতে হবে। নিজের শক্তি ও দুর্বলতা চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী বিসিএসের ক্যাডার টার্গেট ঠিক করতে হবে এবং প্রস্তুতি নিতে হবে।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
জাহিদুর রহমান: সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে জনগণের সেবার যে মহান ব্রত রয়েছে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ পালনের আকাঙ্ক্ষা রাখি। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে কৃষির ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমার জায়গা থেকে বাংলাদেশের কৃষির উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে চাই।