গাড়ির দরজা খুলে দিতেই একরাশ হিমউষ্ণ লবনাক্ত বাতাস এসে ঘিরে ধরলো তাকে। সূর্য এখনো আকাশটার পুব জানালা ছুঁয়ে উঁকি দিয়ে তাকায়নি, কিন্তু তার আগমনী বার্তা ছোপ ছোপ আবিরের মতো লেগে আছে গুঁড়ো গুঁড়ো আকাশময় ছড়িয়ে থাকা কিছু ছিন্ন ছিন্ন মেঘপুঞ্জের গায়ে। ওই আভাই যেন প্রতিসরিত হয়ে একটা হালকা মোলায়েম আলো সারা আকাশময় ছড়িয়ে গিয়ে ঈষৎ আলোকিত করে তুলছে রাস্তার ধার ঘিরে জমে ওঠা বালিয়াড়ি, বালিয়াড়ির কোলে গজিয়ে ওঠা হলুদ ফুলের গুল্মগুচ্ছ, আর বালিয়াড়ি দু’ভাগ করে দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া এক নাম পরিচয়হীন বেলে পথ।
মধ্যবয়স্ক যুবকটি কিছুটা ইতস্তত ভঙ্গিতে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো পিচঢালা কাঁকরময় রাস্তার আবছা হয়ে যাওয়া বাঁকটায়, যেখানে কৃত্রিমতা শেষ হয়ে গিয়ে নিজেকে সমর্পন করে দিয়েছে সমুদ্রদেবীর বালুময় পদযুগলে। অস্বস্তিকর কিছুটা নুড়ি-পাথর আর এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা জলজ দেহাবশেষ পেরিয়ে যুবকটি হেঁটে হেঁটে নেমে যায় নাম পরিচয়হীন বেলে পথ বেয়ে।
একপাশে অগভীর খাড়ি আর ওপর পাশে অতলান্ত মহাসাগর, মাঝে জলসীমার বুক চিরে জমে উঠেছে এক চিলতে লম্বা সরু বালুকাবেলার স্থলভাগ। কোনো এক সময় উঁচু ঢিবির মতন ছিল হয়তো জায়গাটি। দিনে দিনে মানুষের পায়ে পায়ে হয়তো সেই ঢিবি দু দিকে সরে গিয়ে জায়গা করে দিয়েছে অনাহুত আগুন্তুকদের বিরস অভিবাদন জানানোর জন্য।
এই সমুদ্রতটের বালি শুভ্র সাদা। সেই কয়েক সহস্র বছর আগে নদীপথ যখন বন্ধ করে দিয়েছিলো পাহাড় থেকে বেয়ে আনা নানান বিন্যাসের খনিজ আর জৈব মিশ্রিত বালির সরবরাহ, দিনে দিনে সমূদ্রের অনবরত ঘর্ষণে জমে থাকা সমুদ্রতট তখন ধূলিকণায় পরিণত হয়ে বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছিল। রকমারি পীড়ন উৎরে শুধু পড়ে থাকে সর্বংসহা কোয়ার্টজের সাদা গুঁড়ো। আর সাথে করে শম্বুক কোমলাঙ্গ জীবের খোলসের চুর্ণ। মিলেমিশে গড়ে তোলে দিগন্তে গিয়ে মিলিয়ে যাওয়া ওপার বিস্তৃত শ্বেতশুভ্র এক উপাখ্যান। দিনের বেলায় যেখানে কাকচক্ষু স্বচ্ছ সাগর জলে ধুলিহীন গাঢ় নীল আকাশের প্রতিফলন আর সাদা বালিতে বিকিরিত ঝলসানো সূর্যালোক মিলেমিশে অন্ধ করে দেয়া মহাকাব্যের সূচনা করে, সেখানে এখন পিলে চমকানো তিমির আঁধারের শ্বাপদ গর্জন।
মাথার উপরে আংশিক ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের তখনও নিবে যাওয়ার সময় আসেনি। সূর্যের ক্রমাগত আগমনী বার্তায় ধীরে ধীরে ম্রিয়মান চাঁদের দিকে তাকিয়ে যুবকটি বুক ভরে টেনে নেয় একরাশ লবনজ্বলা প্রথম সকালের মিষ্টিমধুর বাতাস। মিষ্টি একটা গন্ধ অনুভব করা যায় এই প্রথম সকালের বাতাসে। নাহ, অচিন কোন বুনো ফুলের রেনু এই গন্ধ বয়ে আনেনি, এই গন্ধ সদ্য ভুমিষ্ট হওয়া সকালের একটা মিষ্টি গন্ধ। ভোরের আলো ফোটাবার হাত ধরে এই গন্ধের সূচনা তা কেবল রাতজাগা সকাল বেলার পাখিরাই বুঝতে পারে।
বালিয়াড়ির সীমা ছাড়িয়ে, অগভীর প্রশস্ত খাড়ির ধারে এখনো সগৌরবে মাথা উচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্পেনিয়ার্ডের লাইট হাউজটা ঠিক তখনও তার একচোখ দিয়ে রাশ বুলিয়ে যাচ্ছে আশেপাশের ডুবোচর আর অগভীর নিমজ্জিত পাথরঘাটাগুলোকে। যেন বিশাল এক একচোখা দৈত্য পরম মমতায় চোখ মেলে সাবধান করে যাচ্ছে আগমনী জাহাজগুলোকে তাদের আসন্ন কোনো বিপদের হাত থেকে।
ক্ষয়িষ্ণু ম্রিয়মান চাঁদ আর সদা সাবধানি লাইট হাউজের উপর চোখ রাখতে রাখতে যুবকটি হাঁটি হাঁটি পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে বালিয়াড়ির ওই বেলে পথটা ধরে। লক্ষ্য তার বালিয়াড়ির সর্ব পূবে গিয়ে সকাল সূর্যের নরম আলোয় নিজেকে ভিজিয়ে নেওয়া। কিন্তু সে তো বহুদূর।
দেখতে দেখতে সূর্যের আলো চারপাশ উদ্ভাসিত করে আলোয় আলোয় ভরিয়ে তুলতে থাকে। খাড়ির অপর পাশে থাকা গাছের মাথাগুলো কমলা সোনালী আলোয় আস্তে আস্তে জ্বলে উঠতে থাকে, যেখানে বাকি দুনিয়াটা এখনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
ঠিক বাকি দুনিয়ার সব না। কু কু শব্দ করে বালিয়াড়ির এপাড় ওপার করে যাওয়া বালিখোচাঁ লম্বা ঠোঁটের পাখি, বালিপথের ধারে-বাহিরে ইতস্তত সদা সাবধানী বালি সাদা কাঁকড়া, আর কাঁকড়া তাড়িয়ে বেড়ানো বিশাল লম্বা পায়ের কিছু ধূসর বক তখনও সম্পূর্ণ জীবন শক্তিতে সক্রিয়।
আর যুবকটি।
ততক্ষণে অনেকখানি পথ হেঁটে আসা হয়ে গেছে। বালিপথে হাঁটা একটু কষ্টকর। পা ফেললেও গোড়ালি থেকে বালি সরে যায়, আগাতে গেলেও পায়ের আঙুল বালিতে ডুবে যায়। ভার সামঞ্জস্য এই দীর্ঘ হাঁটা কেমন যেন অবশ করে দিতে চায় যুবকের পা দুটি। যদিও যুবকটি হেঁটে যায়, থামতে পারেনা, কিংবা থামা যায়না। বালির উপর অনেকক্ষণ হেঁটে যাওয়ার পর কেমন জানি একটা অভ্যেস তৈরি হয়ে যায়। কষ্ট হলেও থামতে আর ইচ্ছে করেনা।
বালিয়াড়ির প্রাচীর এইখানটাতে দু’পাশে কাটা। হয়তো তার মতোই কিছু পথিক একপাশে মহাসাগর আর অন্য পশে জলজমা উপসাগরে যাওয়ার জন্যেই নিজে থেকে আস্তে আস্তে তৈরি করে নিয়েছে। কোনো কিছু চিন্তা না করেই যুবকটি বেছে নেয় মহাসাগরমুখি বহিরাগনটিকে।
সূর্যের মিষ্টি কমলামধুর আলো ততক্ষণে ছেয়ে ফেলছে আধভেজা সমুদ্রতট। সরু পায়ের বালিখোঁচা পাখিগুলো সারি বেঁধে ঠোঁট ডুবিয়ে কি যেন খুঁজে যাচ্ছে ভেজা সমুদ্রতটে। সূর্যের আলো বরাবর চোখ বুলিয়ে দিগন্তে মিশে মহাসাগর আর মহাকালের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো যুবকটি। সকালের হিমউষ্ণ বাতাসে ভেসে ভেসে দূরে কিছু মাছ ধরার নৌকা সাগরের ঢেউয়ে এলোমেলো উঠানামা করছে। আকাশ বেয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে জলকুক্কুটদের ছোট ছোট আলগোছে কিছু দল।
সাগর আজ অনেকখানি শান্ত আর নিস্তরঙ্গ। কেমন যেন নদী নদী মনে হচ্ছে আজ। অনেকটা ক্লান্ত ভঙ্গিতে সাগরের ঢেউগুলো বেয়ে এসে আলতো ছুঁয়ে যাচ্ছে বালুকাবেলার কোল। ভাটা শুরু হয়ে গিয়েছে বোধ হয়।
সমুদ্র তীরের বালুময় বালিয়াড়ির সীমারেখা ধরে পূব কোনে দূরে বহুদূরে যুবকটি একবার চোখ মেলে দেখে নিতে চাইলো সূর্যের এখনকার অবস্থান। এখনই জন্ম নেওয়া সূর্য তখন তার লাজলজ্জা ঢাকতে মুখ লুকাতে যাচ্ছে সাগর বেয়ে ভেসে আসা বিশাল এক মেঘের ঘোমটায়। সকালের আলো পরে এসে কেমন যেন একটা আঁধারির খেলা শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। সূর্যের জমিয়ে যাওয়া তাপে বাষ্পে পরিণত হচ্ছে পূর্বের জোয়ারের ভিজে থাকা বালুকাবেলা। নিস্তরঙ্গ বাতাসে সেই বাস্প মিশে গিয়ে কেমন যেন পুরু এক ছায়াধোয়াশার মহাজগৎ তৈরি করে দিয়েছে।
যুবকটি হাটা শুরু করে দেয়। পুবদিকে স্থলভাগ মিশে গিয়ে যেখানে উপসাগর তার অস্তিত্ব বিলিয়ে দিয়েছে মহাসাগরের হাতে। কিংবা দিগন্ত মিশে গিয়েছে অজানা অসঙ্গায়িত অপর কোনো বহুমাত্রিক জগতের সাথে।
যুবক হেঁটে যেতে থাকে। আর তার হাঁটা পথে বালিতে ফেলে যেতে থাকে কিছু অস্ফুট পদচিহ্ন। সাগরের ক্লান্ত স্রোত আস্তে আস্তে এসে মিলিয়ে দিতে থাকে সেই পদচিহ্নগুলোকে। যেন কোনোদিনও এই পথ দিয়ে কেউ হেঁটে আসেনি। কোনো কালেও না।
লেখক: আমেরিকা প্রবাসী