এবছর দেশে ডেঙ্গুর বিস্তার যতই হোক না কেন, আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা।
এর কারণ হিসাবে তারা বলছেন, এইডিস মশাবাহিত এই রোগে গত কয়েক বছরে অনেকে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ফলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমেছে বলে আবার আক্রান্ত হলে মৃত্যুর ঝুঁকিও বেশি।
ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার বাংলাদেশে এমনিতেই বেশি বলে জানালেন অধ্যাপক ডা. কাজী তরিকুল ইসলাম, যিনি ডেঙ্গু বিষয়ক চিকিৎসার জাতীয় নির্দেশিকার প্রধান সম্পাদক।
ডা. তরিকুল বলেন, “বিশ্বে ডেঙ্গুতে বাংলাদেশে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে বেশি রোগী যে দেশে, সেই দেশেও এত মুত্যু নেই।”
ডেঙ্গু কতটা ভয়ানক হতে পারে, তা ২০২৩ সালেই দেখেছে বাংলাদেশ। গোটা বছরে ৩ লাখের বেশি রোগী শনাক্ত হয়, তার আগে ২২ বছর মিলিয়েও এত রোগী পাওয়া যায়নি।
মৃত্যুর সংখ্যাটিও ছিল উদ্বেগজনক। যেখানে ২০০০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছিল ৮৪৯ জনের, সেখানে শুধু ২০২৩ সালেই সংখ্যাটি হয়ে যায় দ্বিগুণ।
এইডিস মশাবাহিত এই রোগ এবার আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে, এমন শঙ্কা আগে থেকে করে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। বছরের শুরুতে আক্রান্তের সংখ্যাটিও তেমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বছরের প্রথম ছয় মাসে ডেঙ্গুজ্বর নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩ হাজার ৭০২ জন, তার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৪৫ জনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কেবল হাসপাতালে ভর্তি রোগীর পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। সব রোগী হাসপাতালে যায় না বলে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি হওয়াটা স্বাভাবিক।
এর আগে ডেঙ্গু ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে সীমাবদ্ধ থাকলেও গত বছর দেশের ৬৪টি জেলাতেই রোগীর সন্ধান মিলেছিল। অর্থাৎ ডেঙ্গু এখন গোটা দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি।
ডেঙ্গু রোগী সারাবছর মিললেও সাধারণত বর্ষা শেষে জুনের পর এই রোগের প্রকোপ বাড়তে থাকে। অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি নাজুক হয়ে ওঠে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে।
দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু কেন বাড়ছে- এই প্রশ্নে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, যারা একাধিকবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়, তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে।
গত বছর রেকর্ড সংখ্যক মানুষের আক্রান্ত হওয়ার দিকটি দেখিয়ে তিনি বলেন, “গত বছরে ডেঙ্গুর দ্বিতীয় সেরোটাইপে মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়েছে। এবছরও সে আশঙ্কা করছি আমরা। ফলে এবছরও ডেঙ্গু নিয়ে জটিলতা বাড়তে পারে।”
একই শঙ্কা প্রকাশ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, “চলতি বছরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি জটিল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর এই শঙ্কা মৃত্যু নিয়ে। কারণ যতবার মানুষ আক্রান্ত হবে, ততই তার জটিলতা বাড়বে, বাড়বে মৃত্যুঝুঁকিও।”
পুরো দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি দেখিয়ে তিনি বলেন, “অর্থাৎ যারাই আক্রান্ত হবেন, তারা দ্বিতীয় বা তারও বেশিবার আক্রান্ত হবেন। আর যত বেশি বার মানুষ আক্রান্ত হবে, ততই তার মৃত্যুঝুঁকি বাড়বে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর ধরন বদলেছে। বর্তমানে চারটি উপ ধরনের একটি দ্বারা আগে সংক্রমিত হয়ে থাকলে পরে অন্যগুলো দিয়ে সংক্রমিত হলে জটিলতা বেশি হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বেশি কেন- তার ব্যাখ্যায় ডা. তরিকুল বলেন, “প্রথমবারের পর থেকে যতবার মানুষ আক্রান্ত হবে, ততই তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হার মানতে শুরু করবে। আর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যখন কমতে শুরু করে, মানুষ তখন ঝুঁকির কাছাকাছি যেতে থাকে, শকে চলে যায়। মৃত্যুঝুঁকি বাড়ার এটা অন্যতম কারণ।”
মানুষের সচেতনতারও অভাবকেও মৃত্যু বাড়ার জন্য দায়ী করেন তিনি।
“জ্বর হলে মানুষকে চিকিৎসা নিতে হবে, চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে, কিন্তু সময়মতো চিকিৎসা নেওয়া শুরু হয় না বলেই ঝুঁকিটা আরও বাড়তে শুরু করে।”
গত ২০ মার্চ ঢাকার উত্তরায় পরিচ্ছন্নতা অভিযানে গিয়ে মশার উৎপাতে নাকাল হন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম ও ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম।
মৃত্যুতে শীর্ষে বাংলাদেশ
গত বছরে বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। শতাংশের হিসেবে আক্রান্তদের মধ্যে শূন্য দশমিক ৫৩ জন মারা যায়।
কিন্তু গত বছর বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে ব্রাজিলে। সেখানেও এত মৃত্যু নেই। ২০২৩ সালে ব্রাজিলে রোগী শনাক্ত হয় ৩০ লাখ ২৮ হাজার ৫৯০ জন, মৃত্যু হয় এক হাজার ৭৯ জনের। শতাংশের হিসেবে শূন্য দশমিক ০৪ শতাংশ।
পাশের দেশ ভারতে গত বছরে ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল ৯৪ হাজার ১৯৮ জন, মৃত্যু হয় ৯১ জনের; মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ০৯ শতাংশ।
অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি রোগীর দেশ ব্রাজিলের তুলনায় বাংলাদেশে মৃত্যুহার ১০ গুণ বেশি; আর পাশের দেশ ভারতের তুলনায় এই হার বেশি ছয় গুণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, প্রতি বছরে ডেঙ্গুতে ১০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়। ২০২৩ সালে পুরো বিশ্বে মৃত্যু হয় ৫ হাজার ৫০০ জনের বেশি, যার মধ্যে এক হাজার ৭০৫ জনই বাংলাদেশের। চলতি বছর বিশ্বে ৪০ হাজার মানুষ এ রোগে মারা যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন।
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর ৩১ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন এক ডেঙ্গু রোগী। ফাইল ছবি।
গত ৫ বছরের প্রথম ৬ মাসের হিসাব
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানাচ্ছে, চলতি বছরে জানুয়ারিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১ হাজার ৫৫ জন, মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের।
এরপর ফেব্রুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হয় ৩৩৯ জন, মৃত্যু তিনজনের; মার্চে হাসপাতালে ভর্তি হয় ৩১১ জন, মৃত্যু পাঁচজনের; এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি হয় ৫০৪ জন, মৃত্যু দুজনের; মে মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয় ৬৪৪ জন, মৃত্যু ১২ জনের; জুন মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয় ৮৪৯ জন, মৃত্যু নয়জনের।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় ৫৬৬ জন, মৃত্যু হয় ছয়জনের; ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন ভর্তি হয়ে মৃত্যু হয় তিনজনের; মার্চে কারও মৃত্যু না হলেও হাসপাতালে ভর্তি হয় ১১১ জন; এপ্রিলে ভর্তি হওয়া ১৪৩ জনের মধ্যে মৃত্যু হয় দুজনের; মে মাসে হাসপাতালে যাওয়া ১ হাজার ৩৬ জনের মধ্যে মৃত্যু হয় দুজনে; জুনে হাসপাতালে ভর্তি হয় ৫ হাজার ৯৫৬ জন, মৃত্যু হয় ৩৪ জনের।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ১২৬ জন, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ২০ জন করে, এপ্রিলে ২৩ জন, মে মাসে ১৬৩ জন আর জুনে ৭৩৭ জন। বছরের প্রথম এই ছয় মাসে সে বছরে কারও মৃত্যু হয়নি।
২০২১ সালে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুন মাসে কারও মৃত্যু হয়নি। ভর্তি ছিল যথাক্রমে ৩২, ৯, ১৩, ৩, ৪৩, ২৭২ জন।
২০২০ সালে কোভিড মহামারির মধ্যে ডেঙ্গুর বিস্তার ছিল কম। ওই বছরে মোট রোগী শনাক্ত হয়েছিল ১ হাজার ৪০৫ জন, মৃত্যু হয় সাতজনের।
২০২৩ সালের আগে ডেঙ্গুর ভয়ঙ্কর রূপ দেখা যায় ২০১৯ সালে। সে বছরে ডেঙ্গুতে সরকারি হিসেবে আক্রান্ত রোগী লাখ ছাড়ায়; ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন হাসপাতালে গিয়েছিল, মৃত্যু হয়েছিল ১৭৯ জনের। তবে সে বছরও জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ মাসে কারও মৃত্যু হয়নি। রোগীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩৮, ১৮, ১৭ জন। তবে এপ্রিলে দুজনের মৃত্যু হয়, রোগী ছিলেন ৫৮ জন। মে মাসে মৃত্যু হয়নি, রোগী ছিল ১৯৩ জন। জুনে মৃত্যু হয় সাতজনের, এরপর থেকে মৃত্যু এবং রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।
এডিস মশার লার্ভা খুঁজতে মঙ্গলবার অভিযান চালিয়েছে ডিএসসিসি। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
এইডিস মশার লার্ভা খুঁজতে অভিযানে ডিএসসিসির কর্মীরা। ফাইল ছবি : সকাল সন্ধ্যা
দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ
ডেঙ্গু মোকাবেলার কাজটি দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হচ্ছে এইডিস মশা দমন, আরেকটি হচ্ছে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা।
দুটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ না দেখার কথা আগে েথকে বলে আসছেন বিশেষজ্ঞরা।
২০১৭ সালে দেশে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় বহু মানুষ আক্রান্ত হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রোগতত্ত্ববিদ কে কৃষ্ণমূর্তি বাংলাদেশে এসেছিলেন। পরিস্থিতি দেখে তিনি ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোধে ২২ পৃষ্ঠার একটি পরিকল্পনা দলিলও তৈরি করেছিলেন, যা ২০১৯ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু তার পুরোটা কার্যকর হয়নি।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যত রোগী হবে, ততই মৃত্যু হবে। সঠিক চিকিৎসা না পেয়েও মারা যাবে- এটাই নিয়ম।
“তাই নজর দিতে হবে যেন রোগী না বাড়ে, রোগী ব্যবস্থাপনায় যদি নজর দেওয়া যায়, সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া যায়। তাহলেই কেবল মৃত্যু কমানো সম্ভব হবে, নয়ত না।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক আবদুল্লাহও এখন থেকেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহ“েণর তাগিদ দেন।
“আমরা যদি এখনই সম্মিলিত পদক্ষেপ না নেই, তাহলে কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে, অথবা যাবেই না।”