খুলনা নগরের বেসরকারি গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডে পাশাপাশি দুটি শয্যা। একটিতে শুয়ে আছেন অন্তিমা বিশ্বাস (২৬) এবং পাশের শয্যায় তাঁর ভাইয়ের চার বছরের ছেলে অরিজিত ঢালী। অরিজিতের ডান পা পুরোটাই প্লাস্টার করা। অন্তিমার জ্ঞান ফিরেছে রাতে, তবে কপাল ও মুখে এখনো রক্তের ছোপ ছোপ দাগ লেগে আছে।
আজ রোববার সকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, শয্যায় শুয়ে ‘মায়ের কাছে যাব, মায়ের কাছে যাব’ বলে চিৎকার করছে অরিজিত। অন্তিমা কথা বলতে পারছেন, তবে নড়াচড়া করতে পারছেন না। তিনি তখনো জানেন না তাঁর স্বামী বিশ্বজিৎ বিশ্বাস (৩০) ও দুই বছরের মেয়ে অর্ণি বিশ্বাস আর নেই। আর অরিজিতও জানে না তার মা নীপা ঢালী (২৫) ও দাদি অমরি ঢালী (৪৫) তার কাছে আর কখনো আসবেন না।
আজ রোববার সকাল সোয়া ৯টার দিকে ওই হাসপাতালে গিয়ে অন্তিমা বিশ্বাস ও অরিজিতের রক্তের সম্পর্কের কাউকে পাওয়া যায়নি। কয়েক যুবক তাঁদের দেখাশোনার কাজ করছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অন্তিমাকে এখনো জানানো হয়নি যে তাঁর স্বামী ও মেয়ে মারা গেছে। অরিজিতও জানে না তার মা নেই। স্বজনেরা যাঁর যাঁর বাড়িতে লাশ সৎকারে ব্যস্ত। লাশ সৎকার হয়ে গেলে আবার সবাই হাসপাতালে আসবেন।
ওই যুবকেরা বলেন, গতকাল শনিবার রাত ১১টার দিকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এই দুজনকে গাজী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এখন দুজনই আশঙ্কামুক্ত।
আস্তে আস্তে কথা বলতে পারছেন অন্তিমা বিশ্বাস। কী হয়েছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবাই মিলে চুকনগর বাজারে যাচ্ছিলাম কেনাকাটা করতে। কী করে কী হলো, তা বলতে পারব না। শুনেছি সবার অবস্থা আমার মতো হয়েছে। তাঁরা আড়াই শ বেডে (খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) ভর্তি আছেন।’
খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার শোভনা ইউনিয়নের জিয়েলতলা গ্রামে বিশ্বজিৎ বিশ্বাসের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন শাশুড়ি, শ্যালক, শ্যালকের স্ত্রী ও তাঁদের চার বছরের ছেলে। গতকাল বেলা তিনটার দিকে নিজের ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে করে চুকনগর বাজারে যাচ্ছিলেন বিশ্বজিৎ। ইজিবাইকে ছিলেন বিশ্বজিতের স্ত্রী ও দুই বছরের মেয়ে, শাশুড়ি, শ্যালকের স্ত্রী ও শ্যালকের ছেলে। পথে ইজিবাইকে ওঠেন সাব্বির মোড়ল নামের একজন। সাব্বিরের বাড়ি ডুমুরিয়া উপজেলার খর্নিয়া ইউনিয়নের আঙ্গারদোহা গ্রামে। আর বিশ্বজিতের শ্বশুরবাড়ি গুটুদিয়া ইউনিয়নের বিল পাবলা গ্রামে।
খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক ধরে চুকনগর বাজারে যাওয়ার পথে সামনের দিক থেকে আসা একটি ট্রাক ইজিবাইকটিকে ধাক্কা দেয়। ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে ইজিবাইকটি ছিটকে বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে পড়ে। দুমড়েমুচড়ে যায় সেটি। ঘটনাস্থলেই মারা যান বিশ্বজিৎ (৩০) ও সাব্বির মোড়ল (২৩)। গুরুতর আহত অবস্থায় ডুমুরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পর মারা যান বিশ্বজিতের শ্যালকের স্ত্রী নীপা ঢালী (২৫) ও শাশুড়ি অমরি ঢালী (৪৫)। ওই হাসপাতাল থেকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যায় বিশ্বজিতের দুই বছরের মেয়ে অর্ণি বিশ্বাস।
আজ সকালে বাড়িতে মা ও স্ত্রীর লাশ সৎকারে ব্যস্ত ছিলেন অরিজিতের বাবা অপি ঢালী। তিনি বলেন, ‘মা ও স্ত্রীর লাশ সৎকারের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। লাশ সৎকার করতে না পারলে হাসপাতালে যেতে পারছি না।’
বিশ্বজিৎ বিশ্বাসের ছোট ভাই অভিজিৎ বিশ্বাস বলেন, রাতেই দাদা (বিশ্বজিৎ) ও ভাতিজির (অর্ণি) লাশের সৎকার করা হয়েছে। বাড়িতে মাতম চলছে। আকস্মিক এমন ঘটনায় সবাই হতবিহ্বল।
ডুমুরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকান্ত সাহা আজ সকালে বলেন, ওই ঘটনায় গতকাল দিবাগত রাত ১২টার দিকে মামলা করা হয়েছে। বিশ্বজিতের শাশুড়ি অমরি ঢালীর এক আত্মীয় বিশ্বজিৎ ঢালী বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন। ট্রাকটি খর্নিয়া হাইওয়ে থানায় জব্দ করে রাখা হয়েছে।