উদ্বোধনের দুই বছরেরও দৃশ্যমান কার্যক্রম শুরু হয়নি সিলেটের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্কে। কমপক্ষে ১৮টি প্রতিষ্ঠান জমি ও স্থান বরাদ্দ পেলেও কেউই কার্যক্রম শুরু করেনি এখনো। এদিকে, ২০২২ সালের বন্যায় নদীতে বিলীন হয়েছে সীমানা প্রাচীরের মাটি। আবার, এক কিলোমিটারেরও দীর্ঘ স্থানে নেই দেয়াল বা কাঁটাতারের বেড়া। বাকি কালভার্টের কাজও। জায়গায় জায়গায় উঠে যাচ্ছে পার্কের ভেতরকার সড়কের কার্পেটিং। এমন লেজে-গোবরে অবস্থা সত্ত্বেও প্রকল্পের সব ধরনের কাজ সফলভাবে শেষ হয়েছে মর্মে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন খোদ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। প্রকল্প বুঝেও নিয়েছেন পরিচালকের কাছ থেকে।
২০১৬ সালের ৮ মার্চ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে প্রকল্পটির অনুমোদন হয়। ব্যয় ধরা হয় ৩৩৬ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয় ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। পরে ছয় মাস বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়।
এরই মধ্যে ১২টি প্রতিষ্ঠান প্লট এবং ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে ভবনের জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আশা করা হয়েছিল প্রবাসী আধিক্য সিলেটে বড় বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করবে পার্কটি। উৎপাদিত পণ্য ভারতের সেভেন সিস্টার্স এর বাজার ধরবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের বিকাশ হবে। স্থানীয় শ্রমিকসহ অর্ধলক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
প্রকল্প হস্তান্তরের পর কর্তৃপক্ষ দাবি করে শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার, আনসার সদস্যদের ব্যারাক, অভ্যন্তরীণ সড়ক ও কানেক্টিং কালভার্ট, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি অঙ্গন, প্রশাসনিক ভবন, ৩৩ কেভিএ লাইনের ১০ মেগাওয়াট বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন, দৈনিক ২০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহের ক্ষমতাসম্পন্ন গ্যাস স্টেশন, ভূমি উন্নয়ন, সেতু, গেস্ট হাউস, কালভার্ট কাম স্লুইসগেট, ২ হাজার ফুট গভীর নলকূপ, রাস্তা, স্যুয়ারেজ সিস্টেম, ইউটিলিটি ভবন, প্রশাসনিক ভবনের চারপাশের বেড়া ও নালা নির্মাণ সফলভাবে শেষ হয়েছে।
তবে সরজমিনে দেখা যায়, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করায় অনেকস্থানে দেয়াল ধসে গেছে। অন্তত চারটি স্থানে সীমানা প্রাচীরের নিচের মাটি ও বালু সরে গেছে। কোথাও সড়কের পিচ উঠে গেছে। আবার প্রায় দেড় কিলোমিটারজুড়ে কোন সীমানা প্রাচীরই নেই। ফলে পার্কের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। শীতকালেও বিভিন্ন স্থানে জমি আছে পানি। প্রকল্প বুঝে নেওয়ার পরও ২ নম্বর কালভার্ট কাম স্লুইস গেটের নির্মাণকাজ প্রায় ৪০ শতাংশ বাকি। এসব অনিয়ম উঠে এসে এসেছে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের নিজস্ব প্রতিবেদনেও। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে পার্ক সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিম্নমানের কাজের কারণেই এমনটা হয়েছে।
গত বছর ১০ ও ১১ নভেম্বর প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন পার্ক কর্তৃপক্ষের রক্ষণাবেক্ষণ প্রকৌশলী এস এম আল মামুন ও সহকারী প্রকৌশলী ওবায়েত হোসেন। তবে বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদকে বিস্তারিত তথ্য দিতে রাজি হননি সহকারী প্রকৌশলী ওবায়েত। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি ছিল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি আছে সেটা বলব না। আবার একভাবে বলাও যায়।
অনেক কাজ এভাবে অসম্পূর্ণ রেখেই গত ১৭ সেপ্টেম্বর হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষকে প্রকল্প হস্তান্তর করে প্রকল্প পরিচালক ব্যারিস্টার মো. গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া। বর্তমানে তিনি আবার পার্কের পরিচালক (কারিগরি) হিসেবেও দায়িত্বরত। আর হস্তান্তরের ১২ দিন আগেই আইসিটি বিভাগের সচিব বরাবর প্রকল্পের সমাপ্তি প্রতিবেদন পাঠান পার্কের এমডি জি এস এম জাফরউল্লাহ। এমনকি প্রতিবেদন গ্রহণের চিঠিতেও তিনি জানান, প্রকল্পের সব কাজ সফলভাবে শেষ হয়েছে।
এ বিষয়ে এম জাফরউল্লাহ নির্বিকারভাবে বলেন, পার্কে কোনো কাজ বাকি নেই। বন্যায় কিছু জায়গার মাটি সরে গেছে, সেগুলো ঠিক করা হচ্ছে। ছোটখাটো ত্রুটি সব জায়গায় থাকে, থাকতেই পারে। নিজে একটা বাড়ি তৈরি করলে সেখানেও ছোটছোট ত্রুটি ধরা পড়বে।
অন্যদিকে, প্রকল্প পরিচালক গোলাম সরওয়ার বলেন, ২০২২ এ বড় আকারের বন্যা হয়েছিল। তখন সীমানা দেয়ালের কয়েক স্থানে মাটি-বালু সরে নদীতে মিশে যায়। আর যে জায়গায় সীমানা প্রাচীর নেই সে অংশটুকু পরে প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়। এখন হাইটেক পার্কের মাধ্যমে সেখানে কাঁটাতার বসানো হবে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রকল্প শেষ হওয়ার পরে বছরখানেক ‘ওয়ারেন্টি পিরিয়ড’ থাকে। সেই সময় শেষ তাই কিছুই করার নাই; কিন্তু কিছু বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অর্থছাড় আটকে রাখা হয়েছে।